গোকল ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা বৈশাখ মাস ধরে একমাসব্যাপী গাভী পূজার মাধ্যমে এই ব্রত পালন করে। এটি চার বছর পরপর পালন করতে হয়। ব্রতের উদ্দেশ্য হল সাংসারিক সমৃদ্ধি ও স্বর্গবাসের কামনা।
গোকাল ব্রত।।
ব্রতবিধান- এই ব্রত চার বছর পরে উদযাপন করতে হয়। উদযাপনের সময় চারটি রূপার ক্ষুর, সোনার দুটি সিং, একখানা কাপড়, একটি লাঠি আর একটি পাতা রাখালকে প্রদান করবেন। ব্রাহ্মহ্মণকে দিয়ে যথাযথ পূজা করিয়ে দক্ষিণা দিতে হবে। একটি গাভীর মাথায়, শিঙে ও পায়ের ক্ষুরে তেনা সিঁদুর দিতে হবে। কপালে হলুদ, সিঁদুর ও চন্দনের ফোঁটা আর চারটি পায়ে তেলা হলুদ দ্বারা ধৌত করতে হবে। তারপর আঁচল দিয়ে মুছে দিবেন। চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে দিতে হবে। এগুলি প্রথমে শেষ করে কিছু ঘাস গাভীকে খাওয়াতে হবে। এবার গাভীর মুখের সামনে একটি দর্পণ ধরে মন্ত্র বলতে হবে ও বাতাস করতে করতে মন্ত্র বলতে হবে।
।। ব্রতমন্ত্র।।
গোকাল গোকুলে বাস,
গাভীর মুখে দিয়ে ঘাস
আমার যেন হয় স্বর্গবাস।। (৩ বার) ।।
বাতাস করার মন্ত্র।।
রোগ শোক দুর হোক
কীট পতঙ্গ দুরে থাক
মশা মাছি দূর হোক।
তোমাকে ঘুরায়ে পাখা
আমার হোক সোনার শাঁখা
তোমাকে বাতাস করি
সতীন মেরে ঘর করি।।
ব্রতকথা- বাঙালী রমেশবাবু চলেছেন তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ বছরের একমাত্র কন্যা সেফালীকে নিয়ে বৃন্দাবন ধাম দর্শনে। যথাসময়ে তাঁরা বৃন্দাবনের গোকুলে পৌঁছলেন। সেখানে অগণিত মানুষের ভিড় ও নানান কোলাহল শোনা যাচ্ছিল। সেখানে অপর এক পরিবারের সাথে তাঁদের পরিচয় হলো। সেই পরিবারের কর্তা ছিলেন ব্রজমোহনবাবু, সঙ্গে তাঁর কন্যা রমাও ছিলেন। সেই সঙ্গে রমাও সেফালি বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলল। সেখানে পাণ্ডা সবাইকে বললেন গরুকে পূজা কর। সবাই গরুকে পূজা করছে দেখে রমা রহস্য কথা বলে হাসল। বললে-গরুকে কেউ আবার পূজা করে নাকি।
এদিকে সেফালি আর তার মা গাভী পূজা বা গোকাল ব্রত আরম্ভ করল। তাদের দেখে রমা রহস্য করে বললে-এরূপ বাঁকা মুখো গরুকে আমি পূজা করতে পারব না। আবার সেফালিকে বললে-তুই কেমন করে অনার্য্যের মত গরু পূজা করছিস? উত্তরে সেফালি বললে-গরু যে আমাদের দেবতা, মায়ের মত আমাদের দুধ দান করে। একদা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই গোকুলে গরুর সেবা করেছিল। তারপর আর কোন কথা হল না। যে যার কাজে লিপ্ত থাকল। পরে যথাসময়ে যে যার বাড়ী ফিরে গেল।
অচিরে রমার অহঙ্কার চূর্ণ হল। বাড়ীতে ফিরে গিয়ে তার ভীষণ অসুখ হল। সেই জ্বরে তার জিব আরষ্ট হয়ে গেল। কোন কথা সে ভাল ভাবে উচ্চারণ করতে পারল না। সহসা শেফালি একদিন তাদের বাড়ী গিয়ে পৌঁছাল। শেফালি বৃন্দাবনের কথা রমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললে-তুই গোকাল ব্রত করলে এমনি করে আর অসুখে কষ্ট পাবি না। তাই শেফালির কথামত রমা ভক্তি ভরে গোকাল ব্রতানুষ্ঠান করতেই আর তার অসুখ থাকল না। গরুকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে পূজা করলে মানুষের কন্যান হয় সুখশান্তি ফিরে আসে।
ব্রতফল - গাভী হিন্দুদের নিকট মা ভগবতীর তুল্য। তাই হিন্দুগণ গাভীকে পূজা করে থাকে। ভারতবর্ষের মেয়েরা ছোটবেলা থেকে গোরুকে শ্রদ্ধাভক্তি করতে শিক্ষা করে। গোধন সেবায় মানবের সুখ শান্তি বজায় থাকে।
0 Comments