ইতুপূজা ( Itu Puja ) একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব যা পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য পূর্ব ভারতীয় রাজ্যে পালিত হয়। এই উৎসবটি মা দুর্গা উপাসনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত। ইতুপূজা প্রায় পুজো হয়, যা মা দুর্গার পূজা এবং সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত।
ইতুপূজা উৎসবটি অক্টোবর মাসে আয়োজিত হয়, যা দুর্গাপূজা পর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই উৎসবে হিন্দু বৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ধারার বিভিন্ন আয়োজনে শান্তি ও খুশির সাথে মা দুর্গার পূজা ও প্রার্থনা অবস্থান করে। সুন্দর দেকোরেশন, ধার্মিক গানের প্রদর্শন, কৃষ্ণ লীলা, দেবী দুর্গার মূর্তির প্রদর্শন, এবং আল্পনা পুতুল নাটকের প্রদর্শন ইতুপূজা উৎসবের অংশ।
ইতুপূজা সময়ে বাঙালি পরিবারের সদস্যরা একসাথে আসে, একসাথে মিলে সময় কাটানোর জন্য খাবার প্রস্তুত করে, আল্পনা পুতুল নাটক প্রদর্শন করে, এবং পর্বের আত্মসাত অংশ নেয়। এটি বাঙালি সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরম্পরাগতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন এবং বাঙালি সমুদায়ের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
ইতুপূজা ব্রত
ব্রত পালনের মাস - অগ্রহায়ণ মাস
এই ব্রত শোনার নিয়ম- এই পূজায় হাতে দূর্বা ও আলোচাল নিয়ে ব্রতকথা শুনতে হয়।
মন্ত্র :
অষ্ট চাল অষ্ট দূর্বা কলম পাত্রে থুয়ে
শোন সবে ইতুর কথা ভক্তিযুক্ত হয়ে।।
ইতু দেন বর-
ধনধান্যে পুত্র-পৌরে ভরে উঠুক ঘর।।
ব্রতের নিয়ম :
কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন এই ব্রত শুরু করে অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার দিন এই পূজা করতে হয়। সারাটা অগ্রহায়ণ মাস ধরে এই ইতু পূজা করতে হয় কোনো দিন (রবিবার) বাদ দিতে নেই। বাড়ির যারা যারা এই ব্রত করেন তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে ফলমূল দিয়ে নৈবেদ্য দিতে হয়। তারপর ব্রাহ্মণকে দিয়ে সংকল্প করাতে হয় নিজেদের প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা করে। পরে পূজা করতে হবে। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন এই পূজা শেষ করতে হয় এবং উক্ত দিনে প্রথমে ইতুর সাধ দিতে হয় তারপর সকলে সেই প্রসাদ খায়—এই নিয়মই প্রচলিত।
ব্রতকথা :
এক দেশে এক বামুন তার দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতো। তাদের খুব অভাবের সংসার। বামুন দিন আনলে দিন খাওয়া হয় তাদের। কোনও দিন বা পেট ভর্তি খাবার তাদের জোটে না। এমনি ভাবেই দিন চলতে থাকে।
একদিন হঠাৎ বামুনের পিঠে যাবার ইচ্ছে হল। কিন্তু উপযুক্ত টাকা পয়সা না থাকায় তা পূরণ হয় না। তারপর অতিকষ্টে বামুন ভিক্ষে টিক্ষে করে পিঠের সরঞ্জাম গুলো যেমন—চাল, তেল, গুড়, নারকেল ইত্যাদি যোগাড় করল এবং সেগুলো বামনীকে দিয়ে বলল পিঠে তৈরী করতে তার সঙ্গে বামনীকে এও বলল যে সে যেন একটাও পিঠে অন্য কাউকে না দেয়। সবগুলোই যেন শুধু বামুনকেই দেয়।
এই কথা বলে বামুন একটা বড় দড়ি নিয়ে রান্না ঘরের পিছনে গেলো এবং আড়াল থেকে দেখতে লাগল যে বামনী কাউকে পিঠে দেয় কিনা। এদিকে বামনী যেই একটা করে পিঠে তেলে দেয় ওমনি চ্যাঁ-চোঁ আওয়াজ হয়। যেই একটা করে আওয়াজ হয় ওমনি বামুন সেই দড়িতে একটা করে গিট দেয়, কটা পিঠে হচ্ছে তার হিসাব রাখার জন্য। তার অনেকক্ষণ পর যেই আর আওয়াজ পেলো না তখন বামুন বুঝলো যে সব পিঠে ভাজা হয়ে গেছে। তখন সে বাড়ির ভিতর এলো এবং বামনীকে পিঠে নিয়ে আসতে বলল খাবে বলে।
তারপর বামনী যখন থালায় সাজিয়ে পিঠে গুলো তাকে দিলো তখন সে সেই দড়িতে ফেলা গিঁটের সঙ্গে গুনে গুনে দেখলো যে দড়ির গিটের চেয়ে দুটো পিঠে কম। হিসাবে গরমিল। দেখে তো বামুন রেগে আগুন হলো। বামনীকে জানতে চাইল বাকী দুটো পিঠে কোথায় গেলো। বামনী প্রথমে বলতে না চাইলেও বামুনের রাগ আর ধমকানিতে, শেষ পর্যন্ত স্বীকার করল যে পিঠে করার সময় তার দুটো বাচ্ছা মেয়ে বায়না করছিল পিঠে খাবার জন্য। তাই বাচ্ছাদের কান্না থামাতে তাদেরকেই একটা করে পিঠে দিয়েছে। বামুন জানল যে নিজের মেয়েদেরকেই তার বউ পিঠে দিয়েছে কিন্তু তথাপি তার রাগ -কমল না বরং বেড়েই গেলো। বামুন তখন ঠিক করলো মেয়ে দুটোকে বাড়ি থেকে তাড়াবে। এই ভেবে মেয়ে দুটোকে নিয়ে বামুন রওনা হল। যাবার সময় বামনীকে বলে গেলো যে তাদেরকে সে তাদের মাসীর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। বামনী কান্নাকাটি করলো। কিন্তু বামুন তাদেরকে নিয়েই গেলো, বামনীর কোনো বাধা সে মানল না। পরদিন ভোরেই মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু বামুন। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের মাসীর বাড়ি না নিয়ে গিয়ে পথের মধ্যে একটা গভীর বনের মধ্যে তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাড়ি চলে এলো। বনের মধ্যে তারা দুজন বাচ্ছা মেয়ে। তারা ভীষণ ভয় পেলো। যত দিন গিয়ে সন্ধ্যা এগিয়ে আসে ততই তাদের ভয় বাড়ে। বনে পশুপক্ষীর ডাক শুনে তারা ভয়ে শিউড়ে ওঠে। এইভাবে তারা সেদিন ভয়ে ভয়ে কখন যে পথে পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তা নিজেরাই বুঝতে পারেনি। পরদিন সূর্যের একটু আলো ফুটতেই তারা দুজনে হাঁটতে শুরু করল। বহু পথ হেঁটে হেঁটে তারা একটা বাড়ির সামনে এলো। বাড়ির গিন্নী বেড়িয়ে এসে তাদেরকে দেখেই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো যে তারা কারা, একা একা এখানে তারা কী করছে, এলোই বা কী করে এরকম নানা প্রশ্ন। তার উত্তরে তারা একে একে সমস্ত ঘটনা, তাদের কীভাবে সেখানে আগমন ইত্যাদি ইত্যাদি সব বলল। ব্রাহ্মণের মেয়ের এই কথা শুনে সেই গিন্নী তাদেরকে নিয়ে তার বাড়ির ভিতরে গেলো।
বাড়ির ভিতর ঢুকে তারা দেখলো যে সেই বাড়ির মেয়েরা একটা ঘট রেখে কী যেন একটা করছে। এই দেখে তারা সেই গিন্নীকে জানতে চাইল যে তারা কী করছে। উত্তরে গিন্নী জানালো যে তারা ইতু পূজা করছে। তারা আগের দিন কিছু খায়নি তাই এইপূজা তারা করতে পারছে একথাও বলল গিন্নী। এইকথা শোনামাত্র তারা দুই বোন গিন্নীকে বলল যে আগের দিন তারাও কিছু খায়নি এবং তারাও যে ঐ পূজা করতে আগ্রহী এই কথাও গিন্নীকে বলল। গিন্নী এই কথা শুনে তাদের দুজনের ইতুপূজার সমস্ত জোগাড় করে দিলো। তারপর তারা দুজনেও সেই বাড়ির মেয়েগুলোর সঙ্গে ইতপূজা করতে লাগলো। সেই মাসটা ছিলো অগ্রহায়ণ মাস।
যাইহোক তাদের পূজাতে ভগবান সূর্যদেব সন্তুষ্ট হলেন এবং তাদেরকে দর্শন দিয়ে বর চাইতে বললেন। তখন তারা দুজনে বর চাইলো যে তাদের বাবা খুব গরীব লোক, তার যেন ধন ও পুত্রলাভ হয়। সূর্যদেব তাই বর দিলেন ও চলে গেলেন। এই রকমভাবে সারাটা অগ্রহায়ণ মাস ধরে প্রতি রবিবার তারা দুবোন পূজা করে এবং সূর্যদেবের কাছ থেকে বর লাভ করে। তার সঙ্গে সঙ্গে বামুনের ওদিকে অবস্থা ক্রমশঃ ভালো হতে থাকে। তার দারিদ্রভাব কেটে যেতে থাকে। এরপর অনেকদিন কেটে গেলো। দুই বোন বাড়ি ফিরল। তখন বামনী তার হারানো দুই মেয়েকে ফিরে পেয়ে ছুটে এসে তাদেরকে বুকে টেনে নেয় ও বলে যে তাদের অবর্তমানে বাড়ি একেবারে ফাঁকা হয়েছিলো তার কোনো কাজে মন লাগত না। এখন সব দুঃখ ঘুচে গেলো। কিন্তু তখনও দুবোন ইতপূজা করতে ভোলে নি। তারা সেই পূর্বের মতোই এখন নিজের বাড়িতে ইতুপূজা করতে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে তাদের এই পূজার কথা ও পূজামাহাত্ম্য তাদের বাবা মা জানতে পারল। তার বাবা মনে মনে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো। এরপর থেকে বামুনদের পরিবার যেন সুখ সাচ্ছন্দ্যেই কাটতে লাগল। দু'বোনের সুপাত্রে ভাল বাড়িতে বিয়ে হলো। পৃথিবীতে এইভাবে প্রচারিত ও প্রসারিত হলো ইতপূজা মাহাত্ম্য কথা।
ব্রতফলঃ
ভক্তিভরে যারা এই পূজা ও ব্রত করে তাদের কখনো কোনো অভাব অনটন, দুঃখ, স্পর্শ করতে পারেনা। সকল দুঃখ কেটে গিয়ে তারা পরম সুখী হয়ে থাকে। তার সাথে সাথে পরিবারের সকলেই সুখ সাচ্ছন্দ্য ভোগ করে থাকে। বিবাহিত, অবিবাহিত, সধবা, বিধবা সকল মহিলারাই এই ব্রত পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো বাধা নিষেধ নেই।
0 Comments