কলুই মঙ্গলবার ব্রত একটি হিন্দু ব্রত যা মা কলুই দেবীর উপাসনার জন্য অনুষ্ঠান করা হয়। এই ব্রতটি মূলত বাঙালি হিন্দু মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত। ব্রতে মা কলুই দেবীর পূজা এবং প্রার্থনা করা হয় এবং মহিলারা কলুই দেবীর আশীর্বাদে সুখ, শান্তি, এবং ভাগ্যের কামনা করে।
কলুই মঙ্গলবার ব্রতে মহিলাদের মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়ম ও ব্রতের প্রয়োজনীয় আচরণ থাকে। ব্রতের দিনে মহিলাদের অধিকাংশ অত্যধিক নির্বিঘ্ন রাখতে চেষ্টা করে এবং সকালে স্নান করে পূজা ও আরতি অনুষ্ঠান করে। সকালে শাক-সবজি, ফল, দানা, গোধূলি সহ একটি নির্বিঘ্ন খাবার খাওয়া হয়। ব্রতের দিনে মহিলাদের অধিকাংশ স্ত্রীর সঙ্গে মিলে ব্রতের কাহিনী পড়ে এবং প্রার্থনা করে, এবং কলুই দেবীর মূর্তির পূজা করে। ব্রতের শেষে কলুই দেবীর প্রতিমা জলে বা গঙ্গা নদীতে স্নান করানো হয়।
কলুই মঙ্গলবার ব্রত মহিলাদের সমাজে একটি গৌরবশালী অনুষ্ঠান এবং দান-পুন্যের একটি অসুখী বা প্রয়োজনীয় স্থানে ব্রত অনুষ্ঠান করার একটি সুযোগ প্রদান করে।
কলুই মঙ্গলবার ব্রত
ব্রত পালনের মাস- অগ্রহায়ণ মাস
ব্রতের নিয়ম :
অগ্রহায়ণ মাসের চারটি মঙ্গলবারেই এই ব্রত করতে হয়। প্রতি মঙ্গলবারে ঘটস্থাপন করে তারপর পাঁচজন সধবাকে নিয়ে ব্রত কথা শুনতে হয় এবং তৎপরে ফলাহার করতে হয়। প্রথমে একটি কুলের ডাল পুঁততে হয়। তারপর ঘট স্থাপন করে একটা কুলোতে পিটুলির আল্পনায় ১৭টি ডিঙি আঁকতে হয় এবং তারপর সেই কুলোতে ১৭টি কুলপাতা, ১৭টি ফুল, জোড়া কলা, জোড়ামূলো, জোড়া মটরশুঁটি, ১৭ ভাগ নতুন চিড়ে এবং নতুন বইয়ের মুড়কি দিয়ে সাজিয়ে চিনি অথবা আতপ চালের নৈবেদ্য করে দিতে হয়। তারপর ঐ দিন পাঁচজন এয়োকে নিয়ে পূজার জায়গাতে লুচি বা ফলাহার করতে হয়। সারাদিন ও রাত্রে জল খাওয়া যাবে। না একান্ত অসুবিধা বা অসমর্থ হলে পূজার স্থানে গিয়ে গঙ্গাজল একটু খাওয়া যায়।
ব্রতকথাঃ
দীর্ঘদিন আগে এক দেশে একরাজা ছিলো। সেই দেশে এক বামুন ও তার স্ত্রী আর একটা সাত বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাস করতো। এই বামুন তার মেয়ে বউকে নিয়ে মহাকষ্টে দিন কাটাতো। দুবেলা দু মুঠো খাওয়া তাদের অনেক সময় জুটতো না।
ওদিকে রাজার বাবার শ্রাদ্ধ। কিন্তু সেই সময়ই দেশে অতিবৃষ্টি দেখা দিলো। তাই রোদের অভাবে রাজা ধান শুকাতে পারে না। শ্রাদ্ধের দিন এগিয়ে আসে রাজা চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর রাজা অনেক চিন্তা ভাবনা করার পর কোটালকে একটা সোনার ভাঁটা দিয়ে ঘোষণা করে দিতে। বলল যে— যে একদিনের মধ্যে রাজার সমস্ত ধান শুকিয়ে দিতে পারবে সে যেন এই সোনার ভাঁটা ধরে তবে যদি কেউ সোনার ভাঁটা ধরে সময় মতো ধান শুকিয়ে দিতে না পারে তাহলে কিন্তু তার গর্দান যাবে এই শর্তানুযায়ী ঘোষণা করতে ঢেঁড়াদার বেরিয়ে পড়ল দেশ ভ্রমণে। কিন্তু আকাশের গতিবিধি দেখে কেউই সেই সোনার ভাঁটা ধরতে রাজী হলো না। সবশেষে রাজবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথে পাশেই পড়ল সেই বামুনের বাড়ি। ঘোষণাটা শোনা মাত্র বামুনের সেই সাত বছরের মেয়েটা ছুটে এলো এবং সেই সোনার ভাঁটাটা ধরল। বামুনতো অবাক। মেয়েকে বকাবকি
করতে লাগলো। কিন্তু মেয়ে তখন বাবাকে বলল যে যদি তারা ভক্তিভরে সবাই মিলে সূর্যদেবের পূজা করে তাকে সন্তুষ্ট করে ওই ধান শুকিয়ে দিতে পারে তবে তাদের ভিখারী দশা কাটবে, তারা সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। শেষ পর্যন্ত বামুন সম্মতি জানিয়ে ধান ঘরে তুলল। তারপর সেই বামুন, বামনী আর মেয়েটা মিলে খুব করে সূর্যদেবের পূজা করলো। সূর্যদেবের দয়া হল। তিনি তাদের ঘরের মধ্যে তীব্র আলো দিলো। সেই রোদে ধান সব শুকিয়ে গেলো, বামনী তখন সেগুলো গুছিয়ে বস্তাবন্দী করে রেখে দিলো।
এরপর রাত্রে তারা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল। রাত্রির প্রথম প্রহরে সূর্যদেব এলেন তাদের বাড়ির সামনে। দরজার কড়া নাড়ালেন। তাতে ঘুম ভাঙল মেয়েটার সে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো কে যেন একজন লাল রঙের কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেলো এবং দরজা খুলল না। তারপর সূর্যদেব তাকে বহু ডাকাডাকি করলো কিন্তু কেউ দরজা খুলল না দেখে তিনি চলে গেলেন এমন সময় মেয়েটার খুবজোরে প্রস্রাব পেলো। সে তখন তাদের ঘরের পাশের কলাগাছ তলায় গিয়ে বসে প্রস্রাব করে এসে শুয়ে পড়ল। পর দিন সকালবেলা সে দেখলো যে কলাগাছে একটা জোড়াকলা হয়েছে। মেয়েটা সেই জোড়াকলা দুটি লোভবশত খেলো।
ওদিকে রাজার লোক এলো চাল নিয়ে যেতে। নিয়ে গেলো ভালোয় ভালোয় রাজার বাবার শ্রাদ্ধও হয়ে গেলো। রাজা খুশী হয়ে সেই বামুনদের অর্থদান করলো ঘরবাড়ি তৈরী করে দিলো। কিন্তু যতদিন যায় বামুনের মেয়ে যেন শুকিয়ে আসতে থাকে। সে কিছু খায় না, মুখে কোনো স্বাদ নেই। এইভাবে চলতে চলতে তার চোখমুখে কালি পড়ে গেলো। পাড়াতে বামুনের বউ বয়স্ক মহিলাদেরকে অনুরোধ করল তার মেয়েকে একটু দেখার জন্য। পাড়ার বয়স্করা এলো তারা সেই মেয়েকে দেখে বলল— যে ওই মেয়ে গর্ভবর্তী হয়েছে ওর বাচ্ছা হবে। এই কথা নিয়ে সবাই কানাকানি করতে থাকে, সাত বছরের মেয়ের বাচ্ছা হবে—এই নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করে। এই খবর পৌঁছায় রাজার কানে। রাজা রাজ্যে অনাসৃষ্টির দায়ে সেই মেয়েকে ধরে আনতে বলল। রাজার আদেশ পেয়ে রাজার লোক গেলো মেয়েটাকে ধরে আনতে। বামুন-বামনী তো ভয়ে আকুল। শেষ পর্যন্ত বামুন তার মেয়েকে নিয়ে চলল রাজসভার দিকে। বাড়ি থেকে বেরুতে যাবে এমন সময় মেয়েটা আবার প্রস্রাব করলো। এবার তার প্রস্রাব করার সাথে সাথে তার পেটখালি হয়ে গেলো এবং সে সাধারণ অবস্থাতে ফিরলো। এরপর রাজসভাতে তারা গেলো। রাজা ধাত্রীকে ডেকে মেয়েটাকে পরীক্ষা করতে বলল। ধাত্রী পরীক্ষা করে জানালো যে অভিযোগ মিথ্যা। মেয়েটার বাচ্ছা হবে না এখন। এরপর রাজা সেই মেয়েকে ধনরত্ন নিয়ে সসম্মানে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো এবং যার থেকে রাজা খবরটা পেয়েছিলো তার মাথা কেটে নেওয়ার নির্দেশ দিলো। মেয়েটা বাড়ি ফেরার পর তার পুনরায় প্রস্রাব পাওয়াতে সে সেই কলাগাছ তলায় আবার গিয়ে যেই প্রস্রাব করলো ওমনি তার আগের মতো পেট হয়ে গেলো।
এইভাবে গর্ভাবস্থায় দশমাস দশদিন থাকার পর তার দুটি ছেলে হল। ছেলে দুটি জন্ম নিলো তার কান থেকে। এই কানের ফুটো থেকে জন্ম নেওয়া ছেলে দুটির নাম রাখা হলো আকুলি আর সুকুলি। তারা দুজন আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। তারপর যখন তারা সাত বছরে পা দিল তখন একদিন তারা দুজন মিলে চণ্ডীতলাতে নদীর ঘাটের উপর বালি নিয়ে-মুঠো মুঠো করে খেলা করছিলো। এমন সময় একজন সওদাগর তার সাত ডিঙি ভৰ্ত্তি মনিমাণিক্য নিয়ে সেই ঘাটে ভিড়ল এবং ডিঙিগুলো রেখে সে খাওয়া দাওয়া করতে ঘাটের উপর উঠল। তখন সেই সওদাগর ছেলে দুটিকে দেখতে পেলো এবং জানতে চাইল তারা কী করছে। আকুলি আর সুকুলি সেই সওদাগরের প্রশ্নের উত্তরে বলল যে তারা সবার অন্ন মাপছে। তারপর এই ছেলেদুটো সেই সওদাগরকে জানতে চাইলো যে ওই ডিঙিগুলোতে কী আছে? উত্তরে সওদাগর মিথ্যা করে তাদেরকে বলেছিলেন যে ভিত্তিগুলোতে লতাপাতা ভর্তি আছে। তাছাড়া অন্যকিছু নেই এই কথা শুনে তাই হোক বলে ছেলেদুটো চলে গেলো বাড়ির দিকে।
তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে সওদাগর যেই ডিঙিতে ঢুকতে গেছে ওমনি সে এক্কেবারে অবাক হয়ে গেলো। সে সত্যি সত্যি দেখলো যে ডিঙি ভর্তি লতা আর পাতাতে ভরে গেছে এবং সাপগুলো ফস ফস করছে। এই দৃশ্য দেখে সওদাগর কাঁদতে লাগলো এবং যেদিক দিয়ে ছেলে দুটো গেছে সেই পথে ছুটে যেতে লাগলো এবং তাদের ধরে তাদের কাছে ক্ষমা চাইলো তাদেরকে মিথ্যা কথা বলার জন্য। ক্ষমা চেয়ে সেই সওদাগর তাদের দুজনকে বলল যে তার সাত ডিঙি যেমন মনিমানিক্যে ভরা ছিলো তেমন করে নিতে। খুব কান্নাকাটির পর আকুলি আর সুকুলি তাকে বলল যে তার বউ যদি কলুই মঙ্গলবার ব্রত করে তবে আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। এই কথা শুনে ব্রতের নিয়মকানুন সবকিছু জানতে চাইল সওদাগর সেই আকুলি আর সুকুলির কাছেই। তখন তারা ব্রতের নিয়ম বলল। তারা বলল—তার বউ যেন অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেকটা মঙ্গলবারে উঠানে আলপনা দিয়ে কুলের ডাল পোঁতে এবং সেখানে ঘটস্থাপন করে। তারপর তার ডিঙির সমান পরিমাণ অর্থাৎ সাতটা ডিঙি তৈরী করে এবং নতুন কুলোতে আলপনাতে সাতটি ডিঙি আঁকে। তারপর তাতে জোড়া কলা, জোড়া কুল, চিঁড়ে মুড়কি, গুড়ের পাটালি দিয়ে পূজা করতে হবে। পূজার পর পাঁচটি এয়োকে নিয়ে পূজার স্থলেই ফলার করতে হবে।
নিয়মকানুন জেনে নেওয়ার পর সওদাগর দেশে ফিরে বউকে সব বলল। তখন তার বউ নিষ্ঠাভরে এই ব্রত পালন করল। সঙ্গে সঙ্গে সওদাগরের সাত ডিঙি আগের মতো মনিমানিক্যে পূর্ণ হয়ে গেলো। তারপর একদিন সওদাগর তার থেকে বেশ কিছু মনিমানিক্য নিয়ে আকুলি ও সুকুলির দেশে এলো এবং তাদের দুজনকে দিয়ে গেলো।
এইভাবে দেশে দেশে এই কলুই মঙ্গলবার ব্রতকথা প্রচারিত ও প্রসারিত হল।
ব্রতফলঃ
এই ব্রত পালন যারা করে তাদের পিতৃ-মাতৃসহ কোনো কুলেই কোনো কলঙ্ক পড়ে না এবং সকলের মনবাঞ্ছা পূরণ হয়ে থাকে। সুখ শান্তি বৃদ্ধি পায়।
You May Like Also Also Like This
0 Comments