লক্ষ্মীপূজা ব্রত
ব্রতকথা:
বরিশাল জেলাতে কোটালি পাড়া নামে এক জায়গাতে এক বামুন পরিবার বসবাস করতো। পরিবারটিতে বামুন তার বামনী আর তাদের বড় মেয়ে ও ছোট এক ছেলে বাস করতো। তারপর হঠাৎ একদিন কী এক অজানা ব্যাধিতে বামুন আর বামনী মারা গেলো। তখন ওই দুই ভাইবোন একেবারে একা হয়ে গেল এবং দিন চলা দায় হল। কোনোদিন অন্ন জুটত, কোনদিন বা জুটত না। ভিক্ষে-বাটা করে যা জুটত তাই তারা কোনোরকমে খেয়ে দিন কাটাতো। কিন্তু এত কষ্টের মধ্যেও তারা সময় মতো ভক্তি করে তাদের কুলদেবী মা লক্ষ্মীকে পূজা করতো। কোনোদিন হয়ত বা তাদের খাওয়া জুটত না তথাপি কিন্তু তারা তাদের এই কুলদেবী তুলসীপাতা আর জল দিয়ে হলেও তারা ভক্তিসহকারে মা লক্ষ্মীর পূজা করতো। তাদের এত ভক্তি দেখে মা লক্ষ্মীর দয়া হল তাদের উপর। তারপর আস্তে আস্তে মা লক্ষ্মীর দয়াতে তাদের অবস্থা ফিরলো দৈন্যদশা কেটে তাদের অবস্থা ভালো হল। ঘর-বাড়ি অর্থকড়ি সবই হল। তখন তারা মা লক্ষ্মীর পূজা চালিয়েই যেতো।
তারপর মেয়েটাকে তার ভাই বিয়ে দিলো। নিজেও বিয়ে করলো। দেখতে দেখতে মেয়েটার একটা মেয়ে হল এবং তারপর তার চারটি ছেলে হলো। ঠিকঠাকই চলছিলো সবকিছু। কিন্তু হঠাৎই নেমে এলো তাদের দুর্দিন। এক মেয়ে আর চার ছেলেকে রেখে মারা গেলো মেয়েটার বর। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সবরকম কষ্ট ঘিরে ধরলো তাদের। ঠিকমতো খাবারও জুটতো না কোন কোন দিন। ক্ষিদের জ্বালায় অস্থির হতো সেই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো। একদিন তাদের ক্ষিদের জ্বালায় কান্না আর সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো ভাইয়ের বাড়ি যাবে কিছু সাহায্য প্রার্থনার জন্য। গেলোও তাই। কিন্তু ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তেমন সাহায্য কিছুই পেলো না। ভাই তখন বাড়িতে ছিলো না। আর তার ভাজ সব কিছু শুনে তাকে নিস্বার্থভাবে সাহায্য করতে রাজী হলো না। সে ননদকে বলল যে সে যদি প্রতিদিন তাদের বাড়ি গিয়ে ধান- চাল ঝেড়ে দিয়ে আসে তাহলে তার থেকে যা ক্ষুদ বেরুবে তাই তার ননদ নিয়ে যেতে পারে। সে তাতেই রাজী হল। এরপর থেকে প্রতিদিন মেয়েটা ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে ধান-চাল ঝেড়ে ক্ষুদ বেরুতো তাই নিয়ে বাড়ি আসতো এবং তা রান্না করে নিজেও তার ছেলে-মেয়েরা খেতো।
একদিন তার ছেলেরা বায়না করে কাঁদতে লাগলো কারণ তারা শুধু ক্ষুদ সেদ্ধ ভাত খেতে পারছে না বলে। সঙ্গে একটু যাহোক কিছু না হলে খাওয়া সত্যিই কষ্টকর দেখে সে ঠিক করলো ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে কিছু চেয়ে আনবে। সে তাই করলো। ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ভাজকে বলল কিছু লাউপাতা দেওয়ার জন্য। কারণ জানতে চাইলে সে ভাঙ্গকে বলল যে সে ওই লাউপাতা রেঁধে তার বাচ্চাদের খাওয়াবে। কিন্তু তার ভাজ তার ভাইয়ের দোহাই এবং বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে লাউপাতা টুকুও দিলো না তাকে। বাধ্য হয়ে সে বিষণ্ণ মনে ফিরে গেলো।
তার দু-একদিন পর সে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছিল। ঘর থেকে ভাজ বেরিয়ে এসে তাকে জানতে চাইলো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কারণ এবং আরো বলল যে তার ননদ যেন তার মাথার উকুন বেছে দিয়ে তবে বাড়ি যায়। কিন্তু সেদিনটা লক্ষ্মীবার ছিলো বলে তার ননদ তার মাথা বাছতে রাজী হল না। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে এসে ননদের হাত থেকে ক্ষুদগুলো কেড়ে নিয়ে বলল যে যদি লক্ষ্মীবারে উকুন দেখা না যায় তাহলে লক্ষ্মীবারে ক্ষুদও নিয়ে যাওয়া যাবে না। ভাজের | এই ব্যবহারে চরম আঘাত পেলো সে। মনের দুঃখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে স্থির করলো যে রাস্তাতে সে যা পাবে তাই সে নিয়ে গিয়ে রাধবে। এই চিন্তা করে চলতে চলতে সে দেখতে পেলো রাস্তায় একটা মরা সাপ। সে ঠাকুরের নাম করে সেটাই তুলে নিয়ে বাড়িতে গেলো এবং সেটাকেই সে একটা পাত্রে করে উনোনে বসিয়ে ফোটাতে লাগলো। কিন্তু বিধাতার বিচিত্র লীলাতে সে দেখলো যে, সে যত সেটাকে ফোটাচ্ছে ততই সেই পাত্র তথা চারিধার ভরে যাচ্ছে সোনার ফেনাতে। আস্তে আস্তে ঘরের চারিপাশ পূর্ণ হয়ে গেলো সেই সোনার ফেনাতে। তখন সে সেগুলো নিয়ে ছেলেদের পাঠালো সোনার দোকানে সেকরার কাছে। তারা সেগুলি নিয়ে তাদের মায়ের কথামতো সেকরার দোকানে গেলো এবং সেগুলো বিক্রি করলো এবং প্রচুর টাকা পয়সা এনে তাদের মাকে দিলো। অর্থকড়ি পেয়ে আস্তে আস্তে সে তার সংসারটাকে সাজালো সুন্দর করে। দেখতে দেখতে তাদের বাড়ি ঘর-দোর সব বদলে গেলো। তাদের আর কোনো অভাব রইলো না। ছেলে-মেয়েগুলো সব বড় হলো। তারপর তাদেরকে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী দেখে সে বিয়ে দিলো। রাজকীয়ভাবে বিয়ে হল তাদের আর সোনাদানার কোন কিছুরই অভাব রইল না। তারপর সেই মেয়েটা এবং তার ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে-জামাই সব মিলে ধুমধাম করে মা লক্ষীর পূজা দিলো। তাদের এই কথা চারিদিকে জানাজানি হল। খবর পেলো তার ভাই, ভাইয়ের বউও। তার সন্দেহ হল ননদের উপর। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না যে কী করে তার ননদের এত সৌভাগ্য ফিরলো। তারপর দুই স্বামী স্ত্রী ঠিক করলো তার ননদও তাদের সব ছেলে-মেয়ে
বউদের নিমতন্ন করে নিজের বাড়িতে আনবে। শেষ পর্যন্ত তারা তাই করলো। খবর পাঠালো ননদের বাড়িতে। নিমতন্ন পেয়ে তার ননদরা সকলে মিলে বেশ সেজেগুজে সোনার গয়না পড়ে এলো ভাজের বাড়িতে। তাদেরকে আসতে দেখে তার ভাই-ভাজ ছুটে গেলো তাদের কাছে, খুব আদর আপ্যায়ন করতে লাগল। তারা বুঝতে পারল যে এদের নিশ্চই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যাইহোক, তাদের যখন তাদের মামা-মামী খেতে দিলো তখন তারা তাদের গায়ের গয়না খুলে তাদের আসনের উপর রাখলো এবং বলল-
সোনা-দানা হীরা মুক্তা ধন্য মান্য গণ্য।
তোদের কল্যাণে আজ মোদের নেমতন্ন।।
চেয়েছিনু ঢোলা ঢোলা লাউ-এর পাত।
এবার খাওরে সোনা তুমি পিঠে ভাত।।
এরপর মেয়েটার ভাই আর ভাইয়ের বৌ দেখতে পেল যে তারা যে খাবার তাদের ভাগ্নে- ভাগ্নেবউ, ভাগ্নীদের খেতে দিয়েছে তারা তা একেবারে না খেয়ে খালি সেগুলোকে তাদের সোনার গয়নাগুলোকে খেতে বলছে। ভাই-ভাজ কিছুই বুঝতে পারল না। ননদকে জানতে চাইল বোকার মতো যে ওরা ওইরকম আচরণ করছে কেন? উত্তরে ননদ ভাজকে বলল যে, যখন তাদের অভাব ছিলো তখন সে একবারো তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য নিমতন্ন করেনি। এমনকি লাউপাতাটুকুও দেয়নি। আর আজ তাদের সোনাদানা-গয়নাগাটির অভাব নেই তাই তাদেরকে নেমতন্ন করে খাওয়াচ্ছেতাই ওরা ওমন করছে। নিজেরা না খেয়ে গয়নাগাটিকে খেতে বলছে। শুনে ভাজ তার ভুল বুঝতে পারল এবং ননদের কাছে ক্ষমা চাইল। ননদ ভাজকে ক্ষমা করে দিলো। তারপর সকলে আনন্দ করে তৃপ্তিভরে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি চলে এলো। এর কিছুকাল পরে ছেলে- মেয়ে-বউদেরকে লক্ষ্মীপূজার নিয়ম পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়ে সেই মেয়েটা বৈকুণ্ঠে চলে গেলো। এইভাবে এই লক্ষ্মীপূজা চারিদিকে প্রচারিত ও প্রসারিত হল।
ব্রতফলঃ
পৌষ মাসের এই লক্ষ্মীপূজা যারা ভক্তিভরে করে তারা দেহরাখার পর তাদের স্থান হয় বৈকুণ্ঠে। তাদের কোনো অভাব অনটন থাকে না। দুঃখ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাদের ধন-যশ বৃদ্ধি পায়। অতুল ঐশ্বর্ষের অধিকারিনী হয়ে থাকে।
0 Comments