মৌনী অমাবস্যা ব্রত (Mouna Amavasya | Mauni Amavasya Brata) হলো একটি হিন্দু ব্রত, যা প্রধানভাবে মহিলা ব্রত হয়। এই ব্রতটি অমাবস্যা তিথি অর্থাৎ নবম চন্দ্রদের আসবার দিনে অবশ্যই পালন করা হয়।
মৌনী অমাবস্যা ব্রতে বিয়ের পর যে মহিলা তাকে এই ব্রত পালন করতে হয়। এই দিনে তাদের পাসে পুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষেধ। এই দিনে তিনি ভগবানের পূজা করে, ব্রতের পানীয় প্রাপ্ত করে, সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রতিদিন একবার খাতে হয়। এই সময়ে ব্রতী মহিলাটি শারদীয় দুর্গাপূজা প্রস্তুতি নেয়। পূর্ণ মাস ব্রতের পর এই পূজা অনুষ্ঠানের দিনে মৌনী মহিলাটি পুরুষদের সঙ্গে আবদ্ধ হয়, পূজার পর তা পুরুষদের আশীর্বাদ নেয় এবং ব্রত সমাপ্ত হয়।
এই ব্রতটি ধারণ করা হয় একটি মৌনী অবস্থায়, যা অকস্মাত বরণাশ্রয় পাবে এবং তার স্ত্রী হয়ে তাকে ধরণের কোন দুঃখ দেখানো হয় না। এই ব্রতটির উদ্দেশ্য স্ত্রীর পাতিত্ব এবং সান্তান সুখের উন্নতি সাধন করা।
মৌনী-অমাবস্যা ব্রত
ব্রতকথা
এক দেশে এক গয়লানী আর এক বিধবা ব্রাহ্মণীর মধ্যে খুব ভাব ছিল। একজন অন্যকে ছেড়ে থাকতে পারত না বললেই চলে। ব্রাহ্মণীর শুধু একটি মাত্র মেয়ে ছিল। আর গয়লানীর ছিল একঘর ছেলে-মেয়ে। একদিন এক ভিক্ষুক ব্রাহ্মণীর বাড়িতে এসে দেখল যে, ব্রাহ্মণী তার মেয়েটিকে নিয়ে বসে আছে। তাদের দেখে ভিক্ষুক বলল, “মা! তোমার এমন সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু ওর ভাগ্য তেমন ভাল নয়। আমি ওর কপাল দেখে বুঝতে পারছি যে, ওর কপালে বৈধব্য-যোগ লেখা আছে।” ব্রাহ্মণী তখন ভিক্ষুকের পায়ে পড়ে বললেন, “আপনি যখন ওর কপাল দেখে ওর বৈধব্য-যোগের কথা জানতে পেরেছেন, তখন তার প্রতিকার কিছু আছে কিনা, আর কী তার প্রতিকার, তাও আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আপনি দয়া করে তাহলে ওর প্রতিকারও আমায় বলে দিন।” ভিক্ষুক বলল, “হ্যাঁ প্রতিকার আছে, আর প্রতিকারও আমি জানি—যদি কারুর কাছ থেকে মৌনী অমাবস্যার ফল পাওয়া যায়, আর সে সেই ফলগুলো দান করে, তাহলে ওর স্বামীকে সেই ফল খাওয়ালে ওর মরা স্বামী বেঁচে উঠবে। তবে তার একটা বিপদ এই আছে যে, সেই ফল যে দান করবে তার কিন্তু খুব অমঙ্গল হবে।” ব্রাহ্মণী বলল, “তাহলে আপনি তারও যাতে অমঙ্গল নাশ হয়, তার উপায় বলে দিন।” ভিক্ষুক বলল, “ঐ যে গাঁয়ের ধারে একটা কুটে রুগী পড়ে আছে, তার মাথায় যদি এক ভাঁড় দই ঢেলে দিয়ে, জিভ দিয়ে চেটে সেই দই তুলে নিতে পারে, তাহলে তার সব অমঙ্গল কেটে যাবে।”
এর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। বামনীর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বর যখন বাসরঘরে বসে বেশ গল্প-গুজব করছে এমন সময় হঠাৎ সে ঢলে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণ বেরিয়ে গেল। বাড়িতে তখন কান্নার রোল উঠলো। ব্রাহ্মণী এর প্রতিকারের কথা জেনে রেখেছিল, আর সে তখন ছুটে গয়লানীর বাড়ি গেল এবং গয়লানীর কাছ থেকে মৌনী-অমাবস্যার সাতটি ফল চেয়ে নিয়ে এসে জামাইয়ের মুখে ছোঁয়াল। সঙ্গে সঙ্গে জামাই বেঁচে উঠলো।
পরের দিন গয়লানী কাঁদতে কাঁদতে ব্রাহ্মণীর কাছে ছুটে এসে বলল, “সই আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই মরে পরে আছে—এখন কী হবে দিদি – তুমি যেমন করে পার আমায় রক্ষে কর।” ব্রাহ্মণী তাকে 'কোন ভয় নেই বলে সান্ত্বনা দিয়ে তখনি এক ভাড় নং নিয়ে গয়লানীকে সঙ্গে করে গাঁয়ের ধারের সেই কুটে রুগীর কাছে গিয়ে সমস্ত দইটা তার মাথায় ঢেলে দিল এবং গয়লানীকে বলল, “এইবার তুমি সমস্ত দইটা জিভ দিয়ে চেটে তুলে নাও সই।” গয়লানী কোনো কিছু মনে না করে আর ঘেন্না না করে সমস্ত দইটা জিভ দিয়ে চেটে তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে কুটের রোগ সেরে সে সুস্থ হয়ে উঠলো। কুটে তখন বলল, “আমি তোমাদের ভক্তি কতদূর তাই পরীক্ষা করছিলুম। আমি পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ। তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। সেখানে গেলে দেখতে পাবে, তোমাদের যেমন সংসার ছিল আবার ঠিক তেমনটিই হয়ে গেছে।”
ব্রাহ্মণী আর গয়লানী তখন কুটেরোগীস্বরূপ নারায়ণের পায়ে পড়ে তাঁর শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাধারী আনন্দময় দিব্যমূর্তি দেখানোর জন্যে তাঁকে বারংবার মিনতি করতে লাগলো। নারায়ণ তখন চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করে তাদের দর্শন দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণী আর গয়লানী বাড়িতে ফিরে এসে দেখল তাদের সাজানো সংসার যেমন ছিল তেমনিই আছে। তখন তারা সকলকে এই ঘটনার কথা জানালো। তখন থেকেই দেশে দেশে মৌনী-অমাবস্যা ব্রতর কথা চারিদিকে প্রচার হতে লাগলো।
0 Comments