জামাইষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রত
সময় বা কাল :
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত করে নিয়ম। সধবা ছেলের মায়েরাই এই ব্রত নিতে ও পালন করতে পারে।
ব্রতের দ্রব্য ও বিধানঃ
ফল, ৬টি পান, ৬টি সুপুরি, বাঁশপাতা, হলুদে ছোপন কাপড়ের টুকরো, নতুন ৬ গাছা সুতো, তেল-হলুদ, চিড়ে, খই ও দই। প্রত্যেক বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত করতে হয়। পিটুলি দিয়ে একটি কালো বেড়াল এঁকে একটা পিটুলির কঙ্কণ গড়ার নিয়ম। ফল-মূলে বাটা সাজাতে হবে। তারপর ৬টা পান ও ৬টা সুপুরি হলুদে ছোপানো কাপড়ের টুকরো বাঁশ পাতায় জড়িয়ে, ৬ গাছা সুতো পাকিয়ে ও হলুদ মাখিয়ে তার সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। এই সুতোকে ষাট সুতো বলা হয়। চিঁড়ে, বই, দই, তেল ও হলুদ দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজো করার নিয়ম। পুজোর শেষে ছেলে-মেয়েদের কপালে হলুদ ভূঁইয়ে ঐ ষটি সুতো তাদের ডান হাে বেঁধে দিতে হয়। পুজোর শেষে ব্রতকথা শুনে ব্রতীকে ফল খেয়ে থাকতে হবে।
রাতের কথা
এক ব্রাহ্মণীর তিন ছেলে আর তিন বউ ছিল। এই তিন বউয়ের ভেতর ছোটবউয়ের খাবার জিনিসের ওপর খুব লোভ ছিল। ঘরের খাবার জিনিস সে নিজে চুরি করে খেতো আর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিতো বাড়ির পোষা একটা কালো বেড়ালের ওপর। বেড়ালটা ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন, সে রোজ গিয়ে মা ষষ্ঠীকে এই চুরি করে খাওয়ার সব কথা বলে নিতো। কিন্তু ছোট বউ নিজের দোষ কখনো স্বীকার করতো না। এমনি করে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে অরণ্য ষষ্ঠীর রতের দিন এসে পড়ল। ব্রাহ্মণী ব্রত করবে, বাড়িতে হবে আনন্দ-উৎসব। ব্রাহ্মণী পুজোর জন্যে নিজের হাতে পায়েস, মিষ্টি, ক্ষীর ও নাড়ু তৈরী করল এবং ছোটবউকে বলল, বউমা, আমি স্নানটা সেরে আসি, তুমি ততক্ষণ এইখানে বসো—দেখো যেন বেড়ালটা কোনো জিনিসে মুখ না দেয়।' ব্রাহ্মণী চলে গেলো স্নান করতে, এদিকে এই সব ভালো ভালো খাবার দেখে ছোটবউ আর লোভ সামলাতে পারলো না। মিষ্টি, ক্ষীর, পায়েস, দই যা পারলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল, আর একটু দই নিয়ে বেড়ালটার মুখে মাখিয়ে দিল। এদিকে ব্রাহ্মণী স্নান করে এসে দেখল যে, খাবারগুলো সব কে যেন খাবলে খেয়ে গেছে। ব্রাহ্মণী ছোটবউকে তখন জিগ্যেস করল, 'ও বউমা। পুজোর মিষ্টিগুলো কে এইরকম করে খাবলে খেয়ে গেল? ছোটবউ বলল, 'কী জানি মা! একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিলুম সে সময় আমার চোখে ধুলো দিয়ে বেড়ালটা সব খেয়ে নিয়েছে। ওই দেখুন না, ওর মুখে সব লেগে রয়েছে।' এই বলে ছোটবউ বেড়ালটাকে বেশ দু'চার ঘা দিয়ে দিল।
শেষে ব্রাহ্মণী আবার সব নতুন করে যোগাড় করে পুজোর ব্যবস্থা করল। এদিকে বেড়ালটা কাদতে কাদতে বনে চলে গেল এবং যেখানে দেবী অরণ্যষষ্ঠী রয়েছেন তার কাছে গিয়ে সব কথা বলে দিল। সব শুনে ষষ্ঠী দেবী বললেন, 'আমি সব জানি—তুই কাদিস নি—আমি শিগগিরই ছোটবউকে এর প্রতিফল দেবো।”
এই ঘটনার কয়েক মাস পরে ছোটবউয়ের সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিল এবং দশ মাস দশ দিন পরে সে ফুটফুটে সুন্দর চাঁদের মতন একটি ছেলে প্রসব করল। ব্রাহ্মণী নাতির মুখ দেখে খুব খুশি হল এবং গরীবদের ডেকে খুব দান ধ্যান করতে লাগল। এদিকে ছোটবউ তার ছেলেকে কোলের কাছে নিয়ে রাত্তিরে নিশ্চিন্দি হয়ে শুলো। কিন্তু হায়, সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গাতে দেখল ছেলে তার কাছে নেই। শাশুড়ী ও বৌয়ের খুব ভাবনা হল, তারা বেশ কয়েকজন লোক দিয়ে চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল, কিন্তু ছেলেকে কোথাও পাওয়া গেল না।
এই রকম করে ছোটবউয়ের পর পর সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে হল, কিন্তু সব কটিই হারিয়ে গেল। রাত্তিরে ছোটবউ ছেলে নিয়ে শুতো আর সকাল হলেই ছেলে
পাওয়া যেত না। তখন পাড়ার সকলে বলতে লাগল যে, ছোটবউ মানুষ নয় নিশ্চয় রাক্ষসী, ছেলেগুলোকে সেই নিশ্চয় খেয়ে ফ্যালে। এই বউকে কিছুতেই বাড়িতে রাখা উচিত নয়, ওকে এখুনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
পাড়ার লোকের সব কথাই ছোটবউয়ের কানে গেল। সে আর সহ্য করতে পারলো না, নিজেই বাড়ি ছেড়ে একদিন বনে চলে গেল। সে বনে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ‘আমার এ কী হল মা ষষ্ঠী? তুমি আমায় সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে দিয়েও সব কেড়ে নিলে কেন মা! আমাকেও তুমি নিয়ে নাও, আমি একদিনও আর বাঁচতে চাই না।' ছোটবউকে এইভাবে আক্ষেপ করতে দেখে মা অরণ্য ষষ্ঠীর দয়া হল, তখন তিনি এক বুড়ীর রূপ ধরে তার কাছে এলেন। তিনি তাকে বললেন, 'এই বন-বাদাড়ে, তুমি একলা বসে কাঁদছো কেন মা?' ছোটবউ তখন সমস্ত ঘটনা মা ষষ্ঠীকে খুলে বলল। মা ষষ্ঠী তখন বললেন, 'ওরে বেটি! আসল কথাগুলো সব লুকিয়ে রাখলি কেন? তুই যে লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ, দুধ, পুজোর মিষ্টি সব নিজে খেয়ে ফেলে শাশুড়ীর কাছে কালো বেড়ালটার নামে দোষ দিতিস তাতে তোর লজ্জা হোত না? সেই কারণেই আজ তোর এই দুর্দশা হয়েছে।' তখন ছোটবউ, বুড়ীর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, 'তুমি কে মা? কেমন করে আমার সব কথা জানলে। আমায় দয়া করো, তা না হলে আমি তোমার পা ছাড়বো না।' মা ষষ্ঠী ছোটবউয়ের কাতরতা দেখে বললেন, 'বাছা! আমিই মা ষষ্ঠী, পৃথিবীর লোক যা করে আমি সব জানতে পারি।' ছোটবউ তখন আবার কেঁদে বলতে লাগল, 'মা। আমি খুবই অন্যায় করেছি, আমার পাপের শেষ নেই, আজ যখন দয়া করে আমায় দেখা দিয়েছো তখন তুমি আমায় রক্ষে করো মা—তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।' মা ষষ্ঠী তখন বললেন, ‘দ্যাখো পথের ধারে ওইখানে একটা মরা বেড়াল পচে পড়ে রয়েছে। যদি এক হাঁড়ি দই ওই বেড়ালটার গায়ে ঢেলে দিয়ে সেই দই জিভ দিয়ে চেটে ফের হাড়িতে তুলতে পারো, তবে তোমার সব ছেলে-মেয়ে আবার ফিরে পাবে।'
এই কথা শুনে ছোটবউ একটুও দেরি করল না, এক হাঁড়ি দই এনে সেই পচা বেড়ালটার গায়ে ঢেলে দিল এবং পরে জিভ দিয়ে চেটে সমস্ত দই আবার হাড়িতে তুলে এনে মা ষষ্ঠীকে দেখালো। মা ষষ্ঠীও ছোটবউয়ের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ছেলে-মেয়েদের ছোটবউকে দিয়ে বললেন, 'এই নাও তোমার ছেলে-মেয়ে। এই অমৃত দই দিয়ে সকলের কপালে ফোঁটা দাও, আর এদের নিয়ে আনন্দে সুখে ঘরকন্না কর। আর কখনও পুজোর জিনিস লুকিয়ে খেয়ে আমার বাহনের নামে দোষ দিও না, ছেলে-মেয়েদের “দূর হ, মরে যা”, কখনো বলো না, অন্য কাউকে যদি বলতে শোন, তো তখন, মা “ষষ্ঠীর দাস” ও “ষাট ষাট” বলবে। এই সব কথা বলে মা অরণ্যষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ছোটবউ তখন তার সাত ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসে তার শাশুড়ীকে প্রণাম করল। শেষে ষষ্ঠীদেবীর সব কথা শাশুড়ীকে জানালো। ব্রাহ্মণী সব শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেল। এখন নাতি-নাতনীকে পেয়ে তার খুব আনন্দ হল। ব্রাহ্মণী অল্পদিনের মধ্যে নাতি-নাতনীর বিয়ে দিল। পরের বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে খুব জাক-জমক করে ছোটবউ অরণ্যষষ্ঠীর ব্রত করল এবং মেয়ে-জামাইকে আনিয়ে জামাইয়ের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিল। সেই থেকে মা অরণ্যষষ্ঠীর মাহাত্ম্যের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই রতকেই জামাইষষ্ঠী বা ষষ্ঠী বাট' বলা হয়।
ব্রতের ফলঃ
এই ব্রত ছেলে-মেয়েদের মায়েরা পালন করলে তাদের ছেলে-মেয়েদের প্রভূত কল্যাণ হয়ে থাকে।
জামাইষষ্ঠী ব্রত কথা সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তর ( FAQ of Jamai Sasthi Brata Katha )
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা কি?
জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা হল একটি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা শাশুড়ি এবং তার জামাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক উদযাপন করে। এটি উপবাস, পূজা এবং ভোজের একটি বিশেষ দিন।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠী কখন পালিত হয়?
জামাই ষষ্ঠী সাধারণত বাংলা মাসের জৈষ্ঠ মাসে (মে-জুন) অমাবস্যার পর ষষ্ঠ দিনে উদযাপিত হয়, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন মাসে পড়ে।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠীর তাৎপর্য কি?
উত্সবটি শাশুড়ি এবং তার জামাইয়ের মধ্যে প্রেম এবং স্নেহের বিশেষ বন্ধন উদযাপন করে। এই দিনটি ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতীর উপাসনা করার জন্য উত্সর্গীকৃত, যাদের আদর্শ পিতা-মাতা হিসাবে দেখা হয়।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠী কিভাবে পালিত হয়?
এই দিনে, শাশুড়ি তার জামাইয়ের জন্য পূজা না করা পর্যন্ত উপবাস করেন। জামাই তার পরিবারের সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে যান। শাশুড়ি তাকে আরতি দিয়ে স্বাগত জানায় এবং সুস্বাদু খাবার খাওয়ায়। পরিবারের মধ্যে উপহার ও মিষ্টি বিনিময়ও হয়।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠীর সময় পরিবেশিত কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার কি কি?
জামাই ষষ্ঠীর সময় পরিবেশিত কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে ইলিশ মাছ, পিঠা, ভাত, ডাল, আলুর ডোম, চাটনি, সন্দেশ, রসগুল্লা এবং মিষ্টি দোই।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠী কি শুধু বাঙালিরাই পালন করে?
জামাই ষষ্ঠী মূলত একটি বাঙালি উৎসব, তবে এটি ভারতের অন্যান্য অংশ যেমন আসাম এবং ওড়িশাতেও উদযাপিত হয়, যেখানে মানুষের একই রকম রীতিনীতি ও ঐতিহ্য রয়েছে।
প্রশ্নঃ মেয়েরাও কি শ্বশুরবাড়ির জন্য জামাই ষষ্ঠী পালন করতে পারে?
যদিও জামাই ষষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবে শাশুড়িরা তাদের জামাইয়ের জন্য উদযাপন করে, কিছু পরিবার এটিকে কন্যাদের জন্য তাদের শ্বশুরবাড়ির প্রতি ভালবাসা এবং সম্মান দেখানোর উপায় হিসাবে উদযাপন করে।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠীর পেছনের ইতিহাস কী?
জামাই ষষ্ঠীর উত্স স্পষ্ট নয়, তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে বাংলায় কয়েক শতাব্দী ধরে উত্সব পালিত হয়ে আসছে। বলা হয়, শাশুড়িরা তাদের মেয়েদের যত্ন নেওয়ার জন্য তাদের জামাইয়ের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার উপায় হিসাবে এটির উদ্ভব হয়েছিল।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠীর সময় কি খাওয়া যাবে তার উপর কোন ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আছে কি?
জামাই ষষ্ঠীর সময় কি খাওয়া যাবে তার কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই। যাইহোক, যেহেতু এটি একটি ঐতিহ্যবাহী উত্সব, তাই অনেক পরিবার ঐতিহ্যবাহী খাবারে লেগে থাকতে এবং আমিষ খাবার এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে।
প্রশ্নঃ জামাই ষষ্ঠীর সময় কি কোন বিশেষ পোশাক পরা হয়?
জামাই ষষ্ঠীর জন্য কোন নির্দিষ্ট পোশাক নেই, তবে অনেক পরিবার শাড়ি, ধুতি এবং কুর্তা-পাজামার মতো ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরতে পছন্দ করে।
0 Comments