দীপাবলি বা দেওয়ালি হল একটি পাঁচ দিন-ব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। তবে জৈন-শিখ ধর্মালম্বীরাও এই সময়ে একই ধরনের উৎসব পালন করে থাকেন।
দীপাবলি–পুরাকাহিনী (Diwali history in Bengali)
অনেকের বিশ্বাস ত্রেতাযুগে দীপাবলিতেই রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ ১৪ বছরের বনবাস শেষ করে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন।
রাম যখন ধর্মপত্নী সীতা ও অনুজ লক্ষ্মণকে নিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গমন করেন, অযোধ্যা নগরীতে রাম-সীতার বিরহে এক প্রকার অন্ধকার নেমে এসেছিল। কোনও আনন্দ ছিল না কারও মনে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে রাবণকে হত্যা করে রাম সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। ওইদিন বাঙালিরা বিজয়া দশমী পালন করেন। দেশের অনেক জায়গায় দশেরায় রাবণ বধ অনুষ্ঠিত হয়। দশেরায় রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার। দীপাবলির দিনে অযোধ্যায় ফেরেন তাঁরা।
রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা অযোধ্যায় পৌঁছানোর ২ দিন আগে হনুমান এসে অযোধ্যাবাসীদের তাঁদের প্রত্যাবর্তনের সুসংবাদ দেন। এতে অযোধ্যাবাসীদের আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু তাঁরা দেখেন দুদিন পর তো অমাবস্যা। যদি ওঁদের ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসে, তাহলে তো রাম-সীতাকে অন্ধকারের মধ্যেই রাজ্যে পদার্পণ করতে হবে। যা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। তাই তাঁদের স্বাগত জানাতেই ঘি-এর প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হয় সারা অযোধ্যা নগরী। ১৪ বছর বনবাস জীবন শেষে রাবণকে নিধন করে রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনে আলোর উত্সবে মেতে উঠেছিলেন সমস্ত অযোধ্যাবাসী। প্রজারা খুশীতে শব্দবাজিতে মেতে ওঠেন। এইভাবে হয়েছিল রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বনবাসের পর রাজ্যে প্রত্যাবর্তন। ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া দীপাবলির আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজির সেই উৎসবকে সামনে রেখেই সর্বত্র প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে এই উৎসব।
আবার দ্বাপর যুগে মহাভারতের পঞ্চপান্ডব হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তন করেন এই দীপাবলির দিনেই। ওইদিনই পঞ্চপান্ডব ১২ বছরের বনবাস, ১ বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরেছিলেন কৃষ্ণের সহায়তায় কৌরবদের পরাজিত করে। আর তাঁদের ফেরার আনন্দে হস্তিনাপুরবাসী সমস্ত নগরীকে প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত করেছিলেন।
“দীপাবলি” নামটির অর্থ “প্রদীপের সমষ্টি”। দীপাবলি মানে আলোর উৎসব। দীপাবলি হল অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জয়, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয়। দীপাবলির সময় নতুন পোশাক পরা এবং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের প্রথাও চালু আছে।
দীপাবলি মূলত পাঁচদিনব্যাপী উৎসব। কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা। পরের দিন চতুর্দশীকে বলা হয় ‘নরক চতুর্দশী’; দীপাবলির দ্বিতীয় দিন। চতুর্দশীর পরে অমাবস্যা তিথি দীপাবলির তৃতীয় দিন হলেও এইদিনটিই দীপাবলি উৎসবের মূল হিসেবে উদযাপিত হয়।
ওইদিন অমাবস্যার রাত্রে শক্তির দেবী কালীর আরাধনা করা হয়। ওইদিনে লক্ষীপুজোও হয়। কথিত আছে ওইদিন ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরদাত্রী রূপে ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। বিষ্ণুপুরাণ মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুররাজ বলিকে পাতালে প্রেরণ করেন; দীপাবলির দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুররাজ বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুদ প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
ওইদিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোট মাটির প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক। বাড়ীর সমস্ত অশুভ শক্তিকে দুর করতে মানুষ প্রদীপের আলোয় নিজেদের সাধের বাড়িটি সাজিয়ে তোলে। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। অমঙ্গল বিতাড়নের জন্য আতসবাজিও পোড়ানো হয়।
দীপাবলি দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়। এইকারণে ওইদিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয়। কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় মোতবাতি জ্বালায়; কেউবা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোট ঘরে আকাশপ্রদীপ জ্বালায়।
আলোকসজ্জার এই দিন অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালানোর দিন। নিজের ভেতরের ও বাইরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন। আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে ওইদিন আত্মাকে প্রজ্বলিত করে, পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন।
দীপাবলির চতুর্থ দিন- কার্তিকা শুদ্ধ: ওইদিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে বিষ্ণুর বরে পরিশুদ্ধ হয়ে পৃথিবী শাসন করেন। ওইদিন গোবর্ধন পূজাও হয়।
পঞ্চম দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া। একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়। ওইদিন বোনেরা তাদের ভাইদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কপালে ফোঁটা দেয়। নরকাসুরকে বধ করার পর ওইদিন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেইথেকে মর্ত্যলোকে ভাইফোঁটার প্রচলন হয়। শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে এই ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দীপাবলি বা দেওয়ালি উৎসবের শেষ হয়।
সকলকে জানাই শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।।
You May Like Also Also Like This
0 Comments