দুর্গাষষ্ঠী ব্রত বা বোধনষষ্ঠী ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি সধবা ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের মহিলারা সাংসারিক মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করেন। এটি আশ্বিন মাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দুর্গাপূজার বোধনের দিনে ষষ্ঠী পূজা হিসাবে পালন করা হয়।
দুর্গাষষ্ঠী ব্রত
ব্রতের নিয়ম:
আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজার ষষ্ঠী অর্থাৎ শুক্লা ষষ্ঠীতে এই ষষ্ঠী করতে হয়। দুর্গাষষ্ঠী ব্রত পালনের প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ ফুল, ফল, ধূপ, দীপ, দূর্বা, আতপচাল ও মিষ্টান্ন সংগ্রহ করতে হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে উপকরণগুলি দিয়ে দেবীর পূজা করতে হয়। এদিন অন্নভোগ বা ভাত খাওয়া নিষিদ্ধ
ব্রতকথা: এই ব্রত সম্পর্কে দুই ধরণের কথা প্রচলিত আছে। দুই ধরণের কথাই নিচে দেওয়া হল-
প্রথমতঃ বহুদিন আগে এক বামন তার দুই ছেলে তিন মেয়ে ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতো। ছোট ছেলে ছাড়া সকলেরই বিয়ে হয়েছে তবে ছেলেপুলে তখনও কারুর হয়নি।
একবছর ষষ্ঠীর আগের দিন বামন সকলকে ডেকে পূজোতে কে কী নিতে চায় তা জানতে চাইলো। সকলেই সকলের পছন্দ মত কাপড় জামা ইত্যাদি চাইল কিন্তু বড় বউ কিচ্ছু চাইলো না। শেষে শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অনুরোধে সে একটা ধুলোমুঠী শাড়ি চাইলো। বামন ফর্দ নিয়ে বাজারে গিয়ে সবার জন্য সব কিছুই পেলো কিন্তু বড় বউয়ের জন্য ধুলোমুঠী শাড়ি পেলো না বহু খুঁজে একটা বুড়ো দোকানীর দোকানে গিয়ে বামন ধুলোমুঠী শাড়ি চাইতে বুড়ো তাকে জানতে চাইলো, যে এই শাড়ি পড়তে চেয়েছে তার কি কোন ছেলে পুলে আছে? উত্তরে বামন জানালে যে না নেই। তখন বুড়ো দোকানী বলল যে মা ষষ্ঠীর দয়া না হলে এই শাড়ি কেউ পড়তে পারে না। তাই সে ওই বামনকে বলল যে তার বড় বউমা যেন পরের দিন ষষ্ঠীর পূজা করেন তাহলে মা ষষ্ঠীর তার উপর দয়া হবে। তাহলেই সে ওই ধুলোমুঠী শাড়ি পড়তে পারবে। আসলে বামুন নিজেই জানত না যে ধুলোমুঠী শাড়িটার মানে কি। এর অর্থ সেই বুড়ো দোকানদারকে জানতে চাইলে সে বলে যে এর অর্থ হল সাদা ধপধপে লালপাড় শাড়ি যে শাড়িটা বাচ্ছার মা পড়ে থাকা অবস্থাতে তার সন্তান ধুলোমেখে তার কোলে উঠতে চাইবে এবং সেই শাড়িতে ধুলোর দাগ লেগে যাবে। এটাই হল ধুলোমুঠী শাড়ি। এই কথা শুনে বামন বাড়ি এসে যে যার কাপড় তাকে দিয়ে দিলো এবং বড় বউকে বলল বছর বছর ধরে শুক্লাষষ্ঠীতে পূজা করতে এবং মানত করতে তবে সে ওই কাপড় পাবে। এই কথা শুনে বড় বউ সেদিন নিরামিষ ভোজন করল পরের দিন মা ষষ্ঠীর পূজা করল। তারপর কিছু দিনের মধ্যেই সে গর্ভবর্তী হল এবং সঠিক সময় মতো একটা ফুটফুটে ছেলের জন্মও দিলো। ছেলে হওয়ার আনন্দে সবাই বিভোর হয়ে উঠলো। তার পরের বছর বড় বউ শাশুড়ী ননদদের নিয়ে এই পূজা করলো। ফলে তাদেরও সকলের সন্তানাদি হল। ছোট ছেলের বিয়ে হলো।
তার কিছুকাল পর বড় বউ একটা লাল পেড়ে ধপধপে সাদা শাড়ি পড়ে আছে এমন সময় তার ছেলে ধুলো মেখে তার কোলে উঠতে এলো। বড় বউ তাকে কোলে তুলে নিলো। ফলে তার সাদা শাড়িতে ধুলোর দাগ হয়ে গেলো। এতে তার ধুলোমুঠী শাড়ি পড়ার সাধ পুরণ হল। এই দেখে বামন-বামনি পরম আনন্দিত হলো। তারপর ধীরে ধীরে এই ব্রতকথা প্রচারিত হলো। এই ব্রত সম্পর্কে যে দ্বিতীয় মত প্রচলিত আছে তা নিম্নরূপ—
পূর্ববঙ্গের লোকেরা এই ব্রত সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করে। তাদের কথা অনুযায়ী ষষ্ঠাদিন মা দুর্গার ঐ ধুলোমুঠী শাড়ি পড়ার বড় সাধ হয়ে ছিলো। এই কথা তিনি মহাদেবকেও শুনিয়ে ছিলেন। এদিকে সেইসময় মা দুর্গা বাপের বাড়ি যাবে বলে জয়া-বিজয়া তার গায়ের ময়লা তুলে দিচ্ছিল তেল হলুদ মাখিয়ে। সেই সময় মা দুর্গা তার নিজের গায়ের ময়লা দিয়ে একটা ছোট্ট মূর্তি তৈরী করেছিলো। সেই মূর্তিটি দেখতে একটা ছোট বাচ্ছার মতো হয়েছিলো। ঠিক সেই সময় নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো এবং এই কান্ড দেখে তার মা দুর্গার স্তন পান করতে ইচ্ছা জাগে। তাই নারায়ণ স্বয়ং ঐ মূর্তির মধ্যে প্রবেশ করে এবং তখনই সেই মূর্তিটি মা মা বলে কেঁদে ওঠে। এই দেখে মা দুর্গা তাকে কোলে নিয়ে স্তন পান করায় এবং মহাদেব তখনই এই খবর স্বর্গ মৰ্ত্ত পাতালে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে সকলে এসে কিছু না কিছু দিয়ে সেই বাচ্ছার মুখ দেখে যায়। এদের মধ্যে শনি ঠাকুরও এসেছিলেন নিজ ভাগ্নার মুখ দেখতে। কিন্তু যখনই শনিঠাকুর ঐ বাচ্ছার মুখ দেখলো তখনই তার অর্থাৎ সেই বাচ্ছাটার মুখ উড়ে গেলো। মা দুর্গার কোল রঙে ভরে গেলো। এই দেখে দুর্গাতো শনিকে মেরে ফেলার অবস্থা করে কিন্তু দেবতারা বাধা দিয়ে তাঁকে মনে করিয়ে দেয় যে তিনি নিজেই শনি ঠাকুরকে এই বর প্রদান করেছিলেন। এরপর দুর্গা মহাদেবকে বলে ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। তখন মহাদেব নন্দীকে আদেশ দেয়, যে উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে তার মাথা কেটে আনতে। নন্দী মহাদেবের আদেশ পেয়ে ত্রিলোক ঘুরে সব শেষে ইন্দ্রের একটা সাদা হাতির মাথা কেটে আনলো। মহাদেব সেই মাথা সেই বাচ্ছার মাথার স্থলে বসিয়ে দিতেই বাচ্ছার প্রাণ ফিরে এলো কিন্তু দুর্গা নিজের ছেলের হাতির মাথা দেখে খুব দুঃখ পেলেন। তখন ব্ৰহ্মাসহ সকল দেবতা দুর্গাকে বললেন যে--সবার আগে ঐ ছেলেরই পূজা হবে। ও থাকবে সবার উপর। ওই হবে সিদ্ধিদাতা গণেশ। ওর পূজা না হওয়া পর্যন্ত কোনো দেবতার পূজা হবে না।
তারপর দুর্গা তার দুই সন্তান কার্তিক ও গণেশকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে সব কথা মাকে শোনালো। শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলো। সেই থেকে সবার আগে গণেশের পূজা স্বীকৃত হলো।
ব্রতফল : যে সমস্ত রমণী এই পূজা করে তাদের যদি সন্তান না থাকে তবে তাদের সন্তান হয়। তারা সুখী হয়ে থাকে।
You May Like Also Also Like This
0 Comments